Sunday, August 21, 2016

জিরো থেকে হিরো - স্যামসন এইচ চৌধুরী

এক জন মানুষের মধ্যে সততা, নিষ্ঠা, শ্রম, মেধা ও শৃংখলা থাকলে তিনি কত উচু স্থানে পৌছতে পারেন তার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত স্কয়ার গ্র“পের প্রয়াত চেয়ারম্যান স্যামসন এইচ চৌধুরী। যিনি প্রচন্ড আস্থা ও মনোবলকে পূঁজি করে  জিরো থেকে হিরো হন। প্রতিকুল
অবস্থাকে পাশ কাটিয়ে শুন্য থেকে স্কয়ার গ্র“প যার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দেশের মধ্যে শীর্ষে উঠে এসেছে এ দেশের শিল্প ও ব্যবসায় যার অবদান প্রশংসনীয় তিনি হলেন প্রয়াত স্যামসন এইচ চৌধুরী।

বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী স্যামসন এইচ চৌধুরী ১৯২৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার কাশীয়ানী থানার আড়–য়াকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তারা বাবা ছিলেন ইয়াকুব হোসেন। স্যামসন চৌধুরী ভারতে পড়াশুনা শেষ করে ১৯৫২ সালে পাবনা জেলার আতাইকুলায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তার পিতা ছিলেন একটি ফার্মেসীর মেডিকেল অফিসার। 


লেখাপড়া শেষ করে কিছুদিন চাকুরী করেছেন। ভাল লাগেনি। বাবাকে বললেন টাকা দাও, ব্যবসা করব। বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে একটি ফার্মেসী খুললেন। চিকিৎসায় বাবার খুব সুনাম ছিল। দূর দুরান্ত থেকে লোকজন আসতো। এক সময় দেখলেন এমবিবিএস ডাক্তারের প্রতি রোগীরা বেশি ঝুঁকছে। তার এক বন্ধু ডাক্তার ছিল। তখন ঐ ডাক্তারকে গিয়ে বলা হল হাটবারের দিন ফার্মেসিতে বসতে হবে। ফার্মেসি ব্যবসা বেশ জমে উঠল। এভাবে ওষুধ বিক্রয় করতে করতেই হঠাৎ একদিন মাথায় চিন্তা এল। আমরা তো ওষুধ তৈরি করতে পারি। যে কথা সেই কাজ। চার বন্ধু এক সঙ্গে মিলে শুরু করল ওষুধ তৈরির কাজ। ২০-২৫ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ওষুধ তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। দেড় বছরে তাদের পুঁজি বেড়ে দাঁড়ায় ৮০ হাজার টাকা। আর চার বছর পর মুনাফা করতে শুরু করেন। এই সফল ও স্বপ্নের গল্প স্কয়ার গ্র“পের স্বপ্নদ্রষ্টা প্রয়াত স্যামসন এইচ চৌধুরীর জীবন কাহিনী।


স্কয়ার বাংলাদেশে আজ এক আস্থার প্রতীক। এ আস্থা একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা। ওষুধ, টয়লেট্রিজ বা ভোগ্যপণ্য যাই হোক না সেটি কিনতে গিয়ে ক্রেতা যদি দেখেন পণ্যটি স্কয়ারের কোন প্রশ্ন ছাড়াই তারা সেটা গ্রহণ করেন। এ আস্থা এই বিশ্বাস একদিনে অর্জিত হয়নি। এটি দীর্ঘকালের তপস্যা ও নৈতিকভাবে বিশুদ্ধ থাকার ফল।


স্কয়ার আজ বাংলাদেশে শীর্ষ স্থানীয় শিল্প গ্র“প। আর এর স্বপ্নদ্রষ্টা হলেন স্যামসান এইচ চৌধুরী। ৫৫ বছর আগে স্যামসান এইচ চৌধুরীর নেতৃত্বে চার বন্ধু মিলে পাবনা শহরে শালগাড়িয়া এলাকায় যে ছোট্ট শিল্প প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেটি আজ মহিরুহ। ১৯৫৮ সালে যে প্রতিষ্ঠান দিয়ে স্কয়ারের যাত্রা শুরু হয়েছিল তার নাম ছিল স্কয়ার ফার্মা। পুঁজির পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ হাজার টাকা। স্যামসন এইচ চৌধুরীরা চার বন্ধু কয়েক দফায় এই টাকার যোগান দিয়েছিলেন। একটি বসত বাড়ীতে স্থাপন করা সেই কারখানায় শ্রমিক ছিল মাত্র ১২ জন। ১৯৬৪ সালে স্কয়ার ফার্মা নাম পরিবর্তন করে করা হয় স্কয়ার ফর্মাসিউটিক্যাল লিঃ। ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও ছিমছাম ছিল কারখানাটি।


স্কয়ার নামের মহত্ব আরও অনেক গভীরে। সেদিন চার বন্ধু মিলে আট হাতে গড়ে তুলেছিলেন এক বর্গাকার চতুর্ভুজের। স্কয়ার মানে হচ্ছে সেই বর্গাকার চতুর্ভূজ। কিন্তু পারফেক্ট না হলে যেমন চতুর্ভূজ বর্গাকার হয় না। তেমনি নৈতিক বিশুদ্ধতা না থাকলে জীবনে সাফল্য লাভ করা যায় না। সেই পারফেক্টের চিন্তা থেকেই তাদের গ্র“পের নামকরণ করা হয় স্কয়ার। এ প্রসঙ্গে স্যামসান এইচ চৌধুরী ঐ সময় বলেছিলেন, স্কয়ার মানেই পারফেকশন। এ জন্যই আমরা নাম রাখলাম স্কয়ার। “আমরা আমাদের পণ্যের মান নিয়ে কখনোও আপোষ করিনি। 

 এ প্রসঙ্গে স্যামসান এইচ চৌধুরী ঐ সময় বলেছিলেন, ১৯৫৬ সালে আমরা ওষুধ তৈরি শুরু করি। ওষুধ, কাঁচামাল সবই আসতো তখন কলকাতা থেকে। ফলে আমরা পাবনায় প্রথম শিল্প উপস্থাপন করি। তখন আব্দুল হামিদ খানের উন্নয়নের সফলতা দেখে মনে হয়েছিল, উনি পারলে আমরা পারবো না কেন? তাকে অতিক্রম করতে আমাদের ১২/১৩ বছর সময় লেগেছিল। ১৯৫৬ সালে শুরু করলেও ১৯৫৮ সালে আমরা পার্টনারশিপ ব্যবসায় যাই। ১৯৬১ সালে আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে প্রাইভেট লিঃ কোম্পানীতে রুপান্তরিত করি। ১৯৬৪ সালে স্কয়ার পাবলিক লিঃ কোম্পানীতে পরিণত হয়। তখনকার বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রিত ছিল। পাশ বইয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা নিতে হতো। তখন এক ডলারের দাম ছিল ১.২৪ রুপী। পাবনা থেকে ঢাকা আসতে তখন ১৪ ঘন্টা সময় লাগতো। আর চট্রগ্রামে ছিল প্রধান আমদানী রফতানী নিয়ন্ত্রকের অফিস। 


প্রথম কারখানা যে ওষুধটি তৈরি হয়েছিল। সেটি ছিল রক্ত পরিশোধনের এস্ট্রন সিরাপ। দেশীয় আমদানিকারকদের কাছ থেকে চড়া দামে কাঁচামাল কিনে তৈরি করা হতো এই ওষুধ। ওষুধ তৈরিতে মানের সঙ্গে আপোষ করার কোন প্রশ্ন ছিল না। ফলে দাম পড়ে যায় বেশি। নাম করা অন্য কোম্পানীর একই ওষুধের দাম কম হলেও বাজারে ছাড়া হয় এস্ট্রন সিরাপ। গুণগত মানের কারণেই এই সিরাপের প্রেসক্রিপশন করতে থাকেন স্থানীয় ডাক্তারেরা। ফলে এক সময় বাজারের নাম করা কোম্পানীর ওষুধের চেয়ে বেশি চলতে থাকে স্কয়ারের তৈরি এ সিরাপ।


এর কিছুদিন পর রফতানী শুরু হয় এই সিরাপের। কিন্তু পাকিস্থান সরকার কর্তৃক বৈদেশিক আয়ের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ থাকার সামর্থ্য থাকলেও শুরুর দিকে ওষুধের কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য তাকে অনেক বাধা বিপত্তি মোকাবেলা করতে হয়েছে। ওষুধের কাঁচামাল আমদানীর লাইসেন্সের জন্য ঘুরতে হয়েছে সরকারের দ্বারে দ্বারে। পাবনা থেকে ঢাকায় এসে লাইসেন্স পাওয়ার জন্য তদ্বির করা ছিল এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু কোন বাধা তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। অবশেষে একদিন দেখা মিলল তৎকালীন আমাদানী রফতানী নিয়ন্ত্রক শফিউল আযমের। তিনি আগ্রহ সহকারে শুনলেন স্যামসান এইচ চৌধুরীর শিল্প গড়ার আগ্রহের কথা। বক্তব্যে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে দেওয়া হলো কাঁচামাল আমদানীর লাইসেন্স। তবে শর্ত দেওয়া হলো ঐ লাইসেন্সের অধীনে ৬ মাসে ২ হাজার রুপীর সমান মার্কিন ডলারের কাঁচামাল আমদানী করা যাবে। এতেই খুশী হয়ে ফিরে যান পাবনায়। ২ বছর চেষ্টার পর লাইসেন্স পাওয়ার আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে স্কয়ার ফার্মেসিটিক্যাল কারখানার মালিকÑশ্রমিক সকলের মাঝে। নতুন উদ্যমে স্কয়ারের যাত্রা শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত এই আমদানীর পরিমাণ ২ কোটিতে বৃদ্ধি পায়। যে কাঁচামাল আমদানী লাইসেন্সের জন্য এক সময় স্যামসন চৌধুরী অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। সেই স্কয়ার আজ নিজেই অনেক ওষুধের কাঁচামাল তৈরি করছে।


১৯৯৫ সালে স্কয়ার টেক্সটাইল খাতে বিনিয়োগ শুরু করে। স্কয়ার সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ টেক্সটাইল খাতে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কনজিউমার পণ্য। এ দুটি খাতে তাদের প্রভৃতির হার ঈর্ষর্ণীয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে স্কয়ার ফার্মেসিউটিক্যাল লিঃ, স্কয়ার স্পিনিংস লিঃ, স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিঃ স্কয়ার কনজিউমার প্রোডাক্টস লিঃ, স্কয়ার ইনফারমেটিক্স লিঃ, স্কয়ার সারাহ নিড ফেবিক্স লিঃ, স্কয়ার হসপিটালস লিঃ, স্কয়ার এগ্রো লিঃ, স্কয়ার হারবাল এন্ড নিউট্রিসিটিক্যাল লিঃ, এজিএস সার্ভিসেস লিঃ, মাছরাঙা প্রডাকশন লিঃ, প্যাকেজস লিঃ, বর্ণালী প্রিন্টার্স লিঃ, ও মিডিয়া কম ও মাছরাঙা টেলিভিশন। এ ছাড়া হাউজিং কোম্পানী শেলটেক, পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ও একুশে টেলিভিশন লিমিটেডে স্কয়ার গ্র“পের শেয়ার রয়েছে।


তিনি প্রাচীন ঢাকার ম্রেট্রোপলিটান চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি (এমসিসিআই) এর সাবেক সভাপতি, মাইডাসের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ফার্মাসিটিউক্যাল ইন্ডাষ্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশানের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান বাংলাদেশ পাবলিক লিসটেড কোম্পানীজ অ্যাসোসিয়শন, চেয়ারম্যান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লি:, ঢাকা ক্লাবের আজীবন সদস্য, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক, এক্সিকিউটিভ মেম্বর বাংলাদেশ ফ্রাঞ্চ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি, ভাইস প্রেসিডেন্ট ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি (আইসিসিআই), উপদেষ্টা ও সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতি, প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ হারবাল প্রোডাক্টস প্রস্তুতকারক সমিতি, চেয়ারম্যান মিউচুয়্যাল ট্রাষ্ট ব্যাংক লিমিটেড, সাবেক চেয়ারম্যান ও টাষ্ট্রি (টিআইবি), চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহবাজপুর টি এষ্টেট লি, পাবনা প্রেসক্লাবের জীবন সদস্য ছিলেন।

এ ছাড়া স্যামসন চৌধুরী ১৯৯৮ সালে আমেরিকান চ্ম্বোর কর্তৃক বিসনেজ এক্সিকিউটিভ অব দি ইয়ার, ২০০০Ñ২০০১ সালে ডেইলি স্টার এবং ডিএইচএল কর্তৃক বেষ্ট এন্টারপ্রেনার অব দি কান্ট্রি, ২০০৩ সালে মার্কেন্টাইল ব্যাংক এওয়ার্ড লাভ করেন, ২০০৫ সালে ব্যাংকার্স ফোরাম এওয়ার্ড লাভ করেন, ২০০৬ সালে আইসএবি ন্যাশনাল এওয়ার্ড লাভ করেন, ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে পর পর দুই বছর দেশের সর্বোচ্চ করদাতা হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৫ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক সেরা করদাতা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি পান। ২০০৯ এবং ২০১০ সালে সিআইপি মনোনীত হন। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি সিঙ্গাপুরে তিনি পরলোকগমন করেন।


দেশের শীর্ষ শিখরে পৌছুলেও ভুলে যাননি অতীত। তিনি পাবনাকে খুব ভাল বাসতেন। তিনি পাবনার অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরীর আধুনিকায়ন করেন। বনমালি ইন্সটিটিউটসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে তিনি সহায়তা করেন। তিনি ছিলেন, পাবনা প্রেসক্লাবের সম্মানিত আজীবন সদস্য। এ ছাড়া পাবনার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রয়েছে তার অবদান। তিনি পরলোকে চলে গেলেও এ সব প্রতিষ্ঠান তাকে স্মরণ করবে চীরকাল।